সোমবার, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:১৬ পূর্বাহ্ন
কালের খবর প্রতিবেদক :
নামেই ফুটপাথ, কোনো কাজে আসে না। রাজধানীর প্রায় সব ফুটপাথই হকারদের দখলে। তাই পথচারিদের ভোগান্তির শেষ নেই। উচ্ছেদ করার কয়েকদিনের মধ্যে আবারও দোকান বসে যায় রাজধানীর রাজপথে। এককথায় বলতে গেলে হকারদের দখলে নগরবাসীর স্বপ্নের ফুটপাত। যদিও পথচারিদের হাঁটার জন্যই এই ফুটপাত। কিন্তু কে মানে কার কথা। তাই সবইতো হকারদের দখলে। সায়েদাবাদ-সদরঘাট, গুলিস্তান, মতিঝিল, পল্টন, নিউমাকেট-ফার্মগেটসহ বেশিরভাগ এলাকার ফুটপাতের চিত্র একইরকম।
সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর নিউমার্কেট ও বায়তুল মোকাররম এলাকার ফুটপাতে বছরের পর বছর দখল করে কাপড়সহ নানা সামগ্রী বিক্রির দোকান বসানো হয়েছে। আর এতে সেখানে পথচারীদের হাঁটাচলা করার সুযোগ নেই। তবে জিপিও অফিসের সামনে বড় এই ফুটপাথে মানুষ হাঁটাই সম্ভব নয়। দু’পাশেই দোকান সাজিয়েছে হকাররা। এই চিত্র বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটেও। খোদ রাস্তার ওপর বসেছে দোকান। তবে ফুটপাত দখলে রাখা হকাররা জানান, রাস্তায় নেমেছি আমরা গরীব মানুষ। কি করে খাবো, এজন্য রাস্তায় কোন রকম বসে ডাল-ভাত খাইয়া জীবন বাঁচাই। বাদ যায়নি যাত্রী ছাউনিও। পুরোটাই হকারদের দখলে। দোকানিদের দাবি, ইজারা নিয়েই দোকান বসানো হয়েছে। তারা এও জানান, লিজ নেওয়া, অবশ্যই এর কাগজপত্র আছে। কাগজ ছাড়া কেউই দোকান বসাতে পারবে না। যথাযথ কর্তৃপক্ষ আসলে তাদেরকে কাগজপত্র দেখাবো। সন্ধ্যা থেকে গুলিস্তানে হকার বসার কথা। কিন্তু ভর দুপুরে রাস্তা দখল করে চলছে ব্যবসা। আলমাস উদ্দিন নামে এক হকার জানান, পুলিশ ও শ্রমিকলীগের নেতারা প্রতিদিন বিকেলের দিকে এসে টাকা নিয়ে যায়। ৩০ টাকা থেকে শুরু করে ৫-৭শ’ পর্যন্ত নিয়ে থাকে।
ফুটপাত পথচারী নাকি হকারদের: পথচারীদের হাঁটাচলার জন্য সড়কের পাশে গড়ে তোলা হয় ফুটপাত। সড়ক নির্মাণের পাশাপাশি শত কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা এই ফুটপাত আসলে কতটা ব্যবহার করতে পারেন পথচারীরা-সেই প্রশ্ন জাগে জনমনে। এই প্রশ্ন আরও ঘুরপাক খায় যখন ফুটপাতে হকারদের পদচারণা, মোটরসাইকেলের অবাধ বিচরণ কিংবা নির্মাণ সামগ্রী রেখে মাসের পর মাস দখল করে রাখা হয়, তখন। ফুটপাত নিতান্তই একটি শহরের সৌন্দর্য। খোলামেলা ফুটপাত দিয়ে হাঁটাচলা করা ঢাকাবাসীর কাছে স্বপ্নের মতন। কেননা ঢাকার সড়কের অধিকাংশ ফুটপাত দেখা যায় কোনো না কোনোভাবে দখলে রয়েছে। কোথাও দেখা যায় সড়কের পাশের ফুটপাতগুলো দখল করে রেখে কাপড়ের দোকান খুলে বসা হয়েছে, কোথাও দেখা যায় চায়ের টং খোলা হয়েছে, কোথাও আবার বাড়িঘরের নির্মাণ সামগ্রী রেখে দখলে নেয়া হয়েছে। ফুটপাতে চলাচলরত ভুক্তভোগীরা বলেন, এখান দিয়ে কেউ চলাফেলা করতে পারে না। একমাত্র যারা কেনাকানা করে তারাই আসে। বাচ্চা ও পরিবার নিয়ে ফুটপাত দিয়ে হাঁটা যায় না এজন্য বাধ্য হয়ে আমাদেরকে রাস্তার মধ্যদিয়ে হাঁটতে হচ্ছে। করোনার মধ্যে একজনের সাথে আরেকজনের ধাক্কাধাক্কি, এটা চলছেই। বাংলামোটর মোড় থেকে ফার্মগেটের যানজটকে দেখে ট্রাফিক আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সড়কের ফুটপাতে কিছু বাইক উঠিয়ে দেয়। মোটরবাইক চালক শাহাজালাল বলেন, রাস্তায় জ্যাম দেখেই ফুটপাতে উঠেছি। বাইকতো ছোট তাই ভেবেছি সহজেই উঠে সামনে গিয়ে নেমে পড়ব। কিন্তু আরও অনেক বাইক ওঠায় ফুটপাতেও জ্যাম লেগে গিয়েছে। শুধুই দোকান আর মোটরযানের কবলে পড়ে থাকে না ফুটপাত, ফুটপাত দখলে রাখছে বিভিন্ন বাড়িঘরের নির্মাণ সামগ্রী। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শেখেরটেকে ঢুকতেই দেখা যায়, ফুটপাতে বালু ফেলে সেই ফুটপাতকে দখলে রাখা হয়েছে।
নিউ মার্কেট ও বায়তুল মোকাররমে ফুটপাতে ৭ হাজার দোকান: জানা গেছে, নিউ মার্কেট ও বায়তুল মোকাররম এলাকায় প্রায় সাত হাজারের মতো দোকান রয়েছে। এর মধ্যে বায়তুল মোকাররম এলাকার ফুটপাতে রয়েছে আড়াই হাজারের মতো। তবে স্থানীয়দের ভাষ্য, এসব দোকান স্থাপনের পেছনে যেমন রয়েছে প্রভাবশালীদের হাত; তেমনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর যোগসাজশে এসব দোকান চালানো হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিউমার্কেট এলাকার এক ব্যবসায়ী বলেন, নিউমার্কেট এলাকায় দোকান দিতে একটা চৌকি ভাড়া নিলেও তার বিল আসে মাসে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা। এই ব্যবসা কন্ট্রোল করেন আড়ালে থাকা নেতারা। তারা কখনও সামনে আসেন না। এখানে ব্যবসা করতে পারাটাই বড় কথা। কে টাকা নিল, সেটা দেখার বিষয় আমাদের না। শুধুই কি রাজধানীর নিউমার্কেট ও বায়তুল মোকাররম এলাকার ফুটপাত দখলে? রাস্তা ও ফুটপাত দখল করা যেন একটি সাধারণ ব্যাপারে পরিণত হয়েছে। যে যার ইচ্ছামতো ফুটপাত দখল করেন। এমন দখলের দৃশ্য রাজধানীর শ্যামলী, আদাবর ও মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড, টাউনহল, কৃষি মার্কেট, তাজমহল রোড ও লিংক রোড এলাকায় অহরহ দেখা গেছে। এছাড়া ফার্মগেট এলাকাসহ রাজধানীর বহু এলাকার ফুটপাত বছরের পর বছর দখলে রাখা হয়েছে। টাকার বিনিময়ে এসব ফুটপাতে দোকান বরাদ্দ দেয়া এবং সেখান থেকে নিয়মিত চাঁদা আদায়ের দৃশ্য দেখা যায়।
ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা: রাজধানীর ফুটপাত হকারদের দখলে থাকায় প্রায়ই ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। তামান্না খান পেশায় একজন বেসরকারি চাকরিজীবী। তিনি জানান, বছর খানেক আগে বিজয়নগরে রাস্তা পারাপারের সময় তিনি বাসের ধাক্কায় গুরুতর আহত হন এবং দ্রুত পঙ্গু হাসপাতালে নেয়া হলে সেখানে তার একটি হাত কেটে ফেলতে হয়। তিনি আরো জানান, রাস্তা পারাপারের ওই সময় তিনি এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যেতে পারতেন যদি ফুটপাতে ভাসমান দোকান না থাকত। তামান্না খান জানান, সেসময় তিনি বিপদ টের পেয়ে দ্রুত ফুটপাতে উঠতে চেয়েছিলেন কিন্তু ফুটপাতে দোকান থাকায় তিনি আর ফুটপাতে উঠতে পারেননি। বর্তমানে তিনি বেকার জীবন পার করছেন। কথা হয় শান্তিনগরে ফুটপাতে বসে ভাজা খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও বিক্রেতা মো. রাসেল হাওলাদারের সঙ্গে। তিনি জানান, মাসখানেক আগে গ্যাসের সিলিন্ডার থেকে আগুন লেগেছিল। তবে বড় ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। এছাড়া এমন আগুন মাঝে-মধ্যেই লেগে থাকে বলে তিনি জানান। পথচারী মো. ইকবাল হোসেন জানান, ফুটপাতে সারি সারি দোকান থাকার কারণে ঠিকমতো হাঁটা যায় না। মাঝে মাঝে ফুটপাতে মানুষের জ্যাম তৈরি হয়। তিনি আরো জানান, একবার মৌচাকে ফুটপাত দিয়ে হাঁটার পথে মানুষের জ্যাম পড়ে তার মানিব্যাগ হারিয়ে যায়। মানিব্যাগে টাকা ছাড়াও মূল্যবান কাগজ ছিল। যা ফের উঠাতে তাকে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়।
হজক্যাম্প-থার্ড টার্মিনালের ফুটপাত হকারদের দখলে: রাজধানীর আশকোনা হজক্যাম্প সড়কের পূর্বপাশ থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থার্ড টার্মিনাল পর্যন্ত আন্ডারপাস নির্মাণ কাজ চলছে। এ নির্মাণ কাজের নিরাপত্তার স্বার্থে সড়কের পূর্ব থেকে পশ্চিম পাশের বিমানবন্দর মহাসড়ক পর্যন্ত এক পাশের ফুটপাতসহ টিনের বেড়া দিয়ে বন্ধ রাখা হয়েছে রাস্তা। অভিযোগ উঠেছে, আরেক পাশের ফুটপাত খোলা থাকলেও, তা দখল করে তাতে বিভিন্ন পণ্যের পসরা সাজিয়ে ফুটপাত দখল করে রেখেছে হকাররা। এতে ফুটপাত দিয়ে চলাচলে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীসহ স্থানীয় বাসিন্দারা। ভুক্তভোগী বাসিন্দারা জানান, ফুটপাত দখল করে সিভিল এভিয়েশনের কর্মচারী মার্কেটের কিছু দোকান মালিক ও স্থানীয় হকাররা বিভিন্ন পণ্যের পসরা নিয়ে বসার কারণে চরম ভোগন্তির শিকার হচ্ছেন। তারা বলেন, বিমানবন্দর থানার এক শ্রেণির পুলিশকে ম্যানেজ করে প্রতিনিয়ত ফুটপাত দখল করে তাতে বিভিন্ন ব্যবসা করছেন হকারসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী। পুলিশের এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে ফুটপাত দখল করে তাতে ব্যবসা করছে বিভিন্ন হকারসহ ওই মার্কেটের কিছু দোকান মালিক। এ কারণে ফুটপাতে জনসাধারণের ভোগান্তির চিত্র দেখেও না দেখার মত ভান করছে টহল পুলিশ। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে পুলিশ জানায়, ফুটপাতে হকারদের বিরুদ্ধে উচ্ছেদ অভিযান অব্যাহত আছে।
ট্রাফিক ও দুই এমপির তৎপরতায় যানজট নেই যাত্রাবাড়ি: ঢাকা-৪ আসনের সংসদ সদস্য ড. আওলাদ ও ঢাকা-৫ আসনের সংসদ সদস্য আলহাজ¦ মশিউর রহমান মোল্লা সজল এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক ওয়ারী বিভাগের তৎপরতায় এবার ঈদুল আজহার আগে-পরে রাজধানীর যাত্রাবাড়ি বাসস্ট্যান্ড এলাকায় চিরচেনা যানজটের দৃশ্য দেখা যায়নি। ঈদের আগে-পরে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশপথ যাত্রাবাড়ির যানজট নিরসনে ট্রাফিক ওয়ারী বিভাগের সঙ্গে একাধিক মতবিনিময় সভা করেন ঢাকা-৪ ও ৫ আসনের সংসদ সদস্যদ্বয়। ওই সভায় যানজটের প্রধান কারণগুলো শনাক্ত করা এবং তা সমাধানে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এতে সড়কের দুই পাশে অবৈধ পার্কিং বন্ধ, যত্রতত্র গাড়ি থামানো নিয়ন্ত্রণের ফলে এ সড়কের গতি বেড়েছে অন্তত দ্বিগুণ। এ গতি অব্যাহত রাখতে সার্বক্ষণিক মাঠে থেকে দায়িত্ব পালন করছেন ওয়ারী ট্রাফিক বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও। এ বিষয়ে যাত্রাবাড়ির ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) পবিত্র বিশ্বাস জানান, যত্রতত্র বাস দাঁড়ানো ও যাত্রী ওঠানো-নামানো বন্ধে চালকদের সতর্ক করায় যানজট অনেকাংশে কমে গেছে। যারা নির্দেশনা মানছে না, তাদের বিরুদ্ধে দেওয়া হচ্ছে মামলা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মুখপাত্র মো. আবু নাছের বলেন, ফুটপাত দখলমুক্ত করতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। নানাভাবে ফুটপাত চিহ্নিত করার মধ্যদিয়ে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হচ্ছে। অতিদ্রুত সময়ে এসব এলাকায় সিটি করপোরেশনের উচ্ছেদ অভিযান চললে ফুটপাতের দোকানপাট অনেকটা কমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।